নিজস্ব প্রতিবেদক, শায়েস্তাগঞ্জ (হবিগঞ্জ): এক দশক আগেও যে জেলার পরিচিতি ছিল চায়ের দেশ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, আজ সেই হবিগঞ্জ জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের এক উর্বর ভূমি হিসেবে। এই অভাবনীয় রূপান্তরের নেপথ্যে রয়েছে এক তরুণের অদম্য স্বপ্ন আর নিরলস প্রচেষ্টা। তিনি মোহাম্মদ মোশাহিদ মজুমদার, যার হাত ধরে জন্ম নেওয়া ‘উদ্ভাবনী বিজ্ঞান ক্লাব’ আজ কেবল হবিগঞ্জ নয়, সারা বাংলাদেশের জন্য এক অনুকরণীয় মডেলে পরিণত হয়েছে।
এক সাধারণ তরুণের অসাধারণ স্বপ্ন : হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার নিশাপাট গ্রামের এক সাধারণ পরিবারে জন্ম মোহাম্মদ মোশাহিদ মজুমদারের। ছোটবেলা থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি ছিল তার তীব্র ঝোঁক। পড়াশোনার পাশাপাশি অব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করার নেশা তাকে আর দশজনের থেকে আলাদা করে তুলেছিল। স্থানীয় স্কুল-কলেজে পড়াশোনা শেষ করে তিনি যখন উচ্চশিক্ষার জন্য ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন, তখনও তার মনের গভীরে একটি স্বপ্ন লালিত হচ্ছিল -নিজের অঞ্চলের জন্য, দেশের জন্য ভিন্ন কিছু করার।
যে উপলব্ধি থেকে বিপ্লবের শুরু : এই গল্পের মোড় ঘুরে যায় বেশ কয়েক বছর আগে, জাতীয় বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণ করার এক অভিজ্ঞতা থেকে। মোশাহিদ গভীরভাবে লক্ষ্য করেন, বিজ্ঞান মেলা এলেই কেবল স্কুলগুলোতে নামমাত্র অংশগ্রহণের জন্য তাড়াহুড়ো শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা প্রায়শই ইউটিউব থেকে ধারণা নকল করে কোনোমতে একটি প্রজেক্ট দাঁড় করায়। মেলার পর সেই চর্চার আর কোনো ধারাবাহিকতা থাকে না। এর ফলে, অসংখ্য প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থী সঠিক দিকনির্দেশনা এবং চর্চার পরিবেশের অভাবে অঙ্কুরেই ঝরে যায়। এই চিত্র তাকে হতাশ করে, কিন্তু একই সাথে তার মনে এক নতুন স্বপ্নের জন্ম দেয়, এমন একটি স্থায়ী ঠিকানা তৈরি করতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা সারা বছর বিজ্ঞান নিয়ে ভাবতে পারবে, গবেষণা করতে পারবে।
মাত্র ১১ জন থেকে ২৭ হাজারের বিশাল পরিবার আজ আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত:
সেই২০১৭ এর ভাবনা থেকেই ২০১৯ সালের ৩রা জানুয়ারি, মাত্র ১১ জন সমমনা বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীকে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘উদ্ভাবনী বিজ্ঞান ক্লাব’। হবিগঞ্জের মাটিতে রোপণ করা সেই স্বপ্নের বীজ আজ এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে। শুরুর দিকের প্রতিকূলতা, সামাজিক সংশয় "এসব করে কী হবে?" কোনো কিছুই দমাতে পারেনি মোশাহিদ ও তার দলকে। তাদের নিরলস পরিশ্রমে ক্লাবটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করে। আজ এই ক্লাবের সদস্য সংখ্যা ২৭,০০০ এরও বেশি এবং এর কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ২৩৩টিরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।
ক্লাবের হাত ধরেই জাতীয় পর্যায়ে বারবার উচ্চারিত হতে থাকে হবিগঞ্জের নাম। জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ২৭ বারেরও বেশি বিজয়ী হওয়ার গৌরব অর্জন করে ক্লাবটি। উপজেলা, জেলা, বিভাগীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বারবার প্রথম হয়ে ক্লাবের সদস্যরা প্রমাণ করেছে, সুযোগ পেলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলেরাও ইতিহাস গড়তে পারে। এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ মোশাহিদ মজুমদার নিজেও অর্জন করেছেন ‘জাতীয় ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’-এর মতো দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ যুব সম্মাননা।
শুধু ক্লাব নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ ইকোসিস্টেম: মোহাম্মদ মোশাহিদ মজুমদার নামটি শুনলে বেশিরভাগ মানুষই তাকে হবিগঞ্জের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘উদ্ভাবনী বিজ্ঞান ক্লাব’-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে চেনেন। কিন্তু পর্দার আড়ালের গল্পটি আরও অনেক বড়। তিনি শুধু একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেই থেমে থাকেননি, বরং হবিগঞ্জের মতো একটি জেলা শহরে তরুণদের জন্য গড়ে তুলেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ ‘উদ্ভাবনী ইকোসিস্টেম’-যেখানে স্বপ্নের বীজ বোনা থেকে শুরু করে তা মহীরুহে পরিণত হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপেই রয়েছে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা ও সহযোগিতা।
এই ইকোসিস্টেম বা স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিবেশটি কোনো বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ নয়, বরং একটি সুপরিকল্পিত চক্র। এর মূলে রয়েছে তরুণদের বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলা এবং চূড়ান্ত ধাপে তাদের উদ্ভাবনকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা।
যেভাবে কাজ করে এই ইকোসিস্টেম: এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে উদ্ভাবনী বিজ্ঞান ক্লাব, যা তৃণমূলের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তোলার প্রাথমিক প্ল্যাটফর্ম। এখানে একজন শিক্ষার্থী যখন একটি আইডিয়া বা স্বপ্ন নিয়ে আসে, তখন শুরু হয় তার আসল যাত্রা।
পরবর্তী ধাপে তার প্রয়োজন হয় দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ। আর সেই চাহিদা মেটাতে মোশাহিদ গড়ে তুলেছেন শায়েস্তাগঞ্জ স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট, রোবটিক্স একাডেমি এবং অর্জন আইটি সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠানে রোবটিক্স, প্রোগ্রামিং ও আইটিসহ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিভিন্ন বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
প্রশিক্ষণের পর একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হয় যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা। এই বাধা দূর করতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ‘রোবটিক্স শপ বিডি’ এবং প্রযুক্তিগত সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘উদ্ভাবনী আইটি লিমিটেড’। ফলে হবিগঞ্জে বসেই একজন উদ্ভাবক তার প্রয়োজনীয় সকল উপকরণ হাতের নাগালে পাচ্ছেন।
এই ইকোসিস্টেমের আরেকটি শক্তিশালী দিক হলো মিডিয়া ও প্রকাশনা। তরুণ উদ্ভাবকদের সাফল্য এবং তাদের গল্প অন্যদের কাছে পৌঁছে দিতে মোশাহিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘দৈনিক দুর্বার’ ও ‘অদম্য ম্যাগাজিন’। এই গণমাধ্যমগুলো স্থানীয় পর্যায়ে রোল মডেল তৈরি করতে এবং উদ্ভাবনী সংস্কৃতিকে আরও বেগবান করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
এ বিষয়ে মোহাম্মদ মোশাহিদ মজুমদার বলেন, “আমার লক্ষ্য শুধু একটি ক্লাব চালানো ছিল না। আমি চেয়েছিলাম এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে, যেখানে একজন তরুণের স্বপ্ন দেখতে কোনো বাধা থাকবে না। আইডিয়া তৈরি থেকে শুরু করে প্রশিক্ষণ, যন্ত্রাংশ সংগ্রহ এবং সবশেষে তার গল্প সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া-প্রতিটি ধাপেই আমরা তার পাশে থাকতে চাই।”
তার এই বহুমুখী উদ্যোগ প্রমাণ করে, তিনি শুধু একজন সংগঠক নন, একজন দূরদর্শী স্বপ্নদ্রষ্টা। তার হাত ধরে হবিগঞ্জে যে উদ্ভাবনী ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে, তা এখন দেশের অন্যান্য অঞ্চলের জন্যও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার প্রতিটি উদ্যোগই একটি আরেকটির পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে।
আগামীর স্বপ্ন: উদ্ভাবনী বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে মোহাম্মদ মোশাহিদ মজুমদার বলেন, “আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইনোভেশন কালচার বা উদ্ভাবনী সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা চাই, উদ্ভাবনী বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে আমাদের আজকের এই খুদে বিজ্ঞানীরা। অনুকরণ নয়, মৌলিক উদ্ভাবনী শক্তি দিয়েই তরুণ প্রজন্ম বিশ্ব জয় করবে। হবিগঞ্জ যদি পারে, তবে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাই পারবে।
তার দেখানো পথে হেঁটে আজ হাজারো তরুণ বিজ্ঞানের জগতে স্বপ্ন দেখছে। মোহাম্মদ মোশাহিদ মজুমদার এবং তার ‘উদ্ভাবনী বিজ্ঞান ক্লাব’ তাই আজ শুধু একটি সফলতার গল্প নয়, এটি একটি বিশ্বাসের নাম, যে বিশ্বাস বলে, এক ব্যক্তির একটি মহৎ স্বপ্ন একটি পুরো অঞ্চলের পরিচয় বদলে দিতে পারে।
দৈনিক দুর্বার